
খুলনা ব্যুরো:
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক বছর সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়ছে প্রলয়ঙ্করী সব ঘূর্ণিঝড়। প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় কয়রাসহ উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভাসিয়ে নেয় হাজারো মানুষের বসতি, কেড়ে নিচ্ছে জীবন-জীবিকা।নিঃস্ব হয় মানুষ।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ বছরে সুন্দরবনের উপকূলীয় জনপদে ১২টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এসব ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সুন্দরবনের উপকূলীয় জনপদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবার ঘূর্ণিঝড় না হলেও প্রতিবছর বর্ষায় নদীর পানি বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
এমন পরিস্থিতিতে জন্মভিটায় টিকে থাকতে বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন উপকূলের মানুষ। এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই বাঁধের অনেক স্থানে শুরু হয়েছে ভাঙন। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আসন্ন বর্ষায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
২ নং কয়রা গ্রামের বাসিন্দা আলামিন ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক বছর উপকূলীয় বেড়িবাঁধের প্রকল্পগুলো নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘসূত্রিতা স্থানীয়দের জানমালের নিরাপত্তা আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
সামনে বর্ষা ও ঝড়ের মৌসুম নতুন করে উৎকণ্ঠায় ফেলেছে উপকূলীয় বাসিন্দাদের।’ বার বার নদী ভাঙন এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্রুত টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি করেছেন তারা।
মহেশ্বরীপুর সিংহেরচর গ্রামের বাসিন্দা বিপ্রদাস মন্ডল বলেন, ‘বিগত দিনের কয়েকবারের ভাঙনে আমার ১১ বিঘা জমি নদীর পেটে চলে গেছে। টেকসই বেঁড়িবাধ না হওয়ায় এখন নতুন করে বিভিন্ন স্থানে বাঁধে ধস দেখা দেওয়ায় ভিটেবাড়ি হারানোর শঙ্কায় রয়েছি।’ তিনি উপজেলায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কয়রায় দেড় হাজার কোটি ব্যয়ে মেগা প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ২৬ শতাংশ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীর মরফলোজিকাল পরিবর্তনজনিত কারণে কাজের নকশা পরিবর্তন সংক্রান্ত জটিলতায় প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। যে কারণে নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ শেষ করা যায়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার বেড়িবাঁধ রয়েছে ৬৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে কয়রায় ১৩২, পাইকগাছায় ১৯০ ও দাকোপে ৩০৮ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় নির্মিত এসব বেড়িবাঁধ ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর অনেকটা ভেঙে পড়েছে। সংস্কার না হওয়ায় মাটি ধসে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৪০ কিলোমিটার বাঁধ। এরমধ্যে ৯ কিলোমিটার বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়রার দুটি পোল্ডারের ৮টি স্থানে ৪ হাজার ১২০ মিটার, পাইকগাছার ৬ স্থানে ৩ হাজার ৪৪৫ মিটার ও দাকোপের ৮ স্থানে ৮৪৫ মিটার বাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
স্থানীয়রা বলছেন, এ তালিকার বাইরেও নতুন নির্মাণ করা বেড়িবাঁধের অনেক স্থান ধসে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, দুর্যোগপ্রবণ খুলনার কয়রা পাইকগাছা, দাকোপ, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ উপকূলীয় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে। কিছু এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাস এবং বর্ষায় নদীতে পানি বাড়ার চাপ থেকে রক্ষায় কয়রা উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার স্থায়ী বেড়িবাঁধের মেগাপ্রকল্পসহ জাইকার অর্থায়নে বেশ কিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা এমনিতেই অনিরাপদ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। উপকূলে ক্রমেই কঠিন হচ্ছে- জীবনের লড়াই। একটির ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই আসে নতুন দুর্যোগ। আর একেকটি দুর্যোগ বদলে দেয় উপকূলের চিত্র। দুর্যোগ বারবার উপকূলীয় জীবিকা ধ্বংস এবং দারিদ্র্য ও বাস্তুচ্যুতির হার বাড়াচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ছাড়াও প্রতিবছর বর্ষায় নদীর পানি বাড়ে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে বাঁধ ভেঙে ক্ষতির শিকার হন তারা। এতে লবণাক্ততা বেড়ে জমির ফসল উৎপাদন কমছে।’
শুভ্র শচীন আরো বলেন, ‘সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় চিংড়িঘেরের কারণে যথেচ্ছভাবে বেড়িবাঁধ কাটাছেঁড়া, ছিদ্র এবং সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে অব্যাহতভাবে বালু তোলায় ঝুঁকিতে পড়ছে বেড়িবাঁধ। পাশাপাশি গত কয়েক বছর বেড়িবাঁধের প্রকল্পগুলো নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘসূত্রতা স্থানীয়দের জানমালের নিরাপত্তা আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।’
খুলনার কয়রা দশহালিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহাদত হোসেন বলেন, ‘উপকূলীয় এ জনপদ স্বভাবগতভাবেই, প্রায় প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। তাছাড়া বর্ষায় নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে বাঁধে ভাঙন তৈরি হয়, বাঁধ ভাঙে। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। নষ্ট হয় ঘরবাড়ি ফসল। ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয় মানুষ।’ উপজেলার কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধের সংস্কারকাজ না হওয়ায় ও নতুন করে ভাঙন দেখা দেওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
কয়রার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা আলতাফ শেখ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস হলে যে কয়টা জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, খুলনার সর্বদক্ষিণের সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রার হরিণখোলা তারমধ্যে অন্যতম। পরিকল্পিত ও স্থায়ী টেকসই বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতিবছরই ভাঙন দেখা দেয়। ঝুঁকিপূর্ণ বর্ষায় বাঁধের স্থায়ী সমাধান করতে হলে নদী শাসনের কাজ করতে হবে। এ জন্য সেখানে পাকা ব্লক ফেলা ছাড়া বিকল্প নেই। তাছাড়া স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পরিকল্পিতভাবে বাঁধ মেরামতের পাশাপাশি বেড়িবাঁধের উচ্চতা আরো অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো প্রয়োজন।’