হোসাইন মৃদুল,নাগরপুর (টাঙ্গাইল)প্রতিনিধি:
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েশিশুদের অধিকার রক্ষার তাগিদ থেকে ‘মীনা’ কার্টুনের জন্ম। শুরুতে শুধু মেয়েশিশুদের অধিকারের কথা বললেও পথপরিক্রমায় সব শিশুরই অধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছে ‘মীনা’। বাংলাদেশ টেলিভিশনে মীনা কার্টুন দেখানোর পাশাপাশি রেডিওতেও প্রচারিত হয় মীনা অনুষ্ঠান।
মীনার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা হিসাব করে ১৯৯৮ সালে ২৪ সেপ্টেম্বরকে ‘মীনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব রিজিওনাল কো–অপারেশন, সংক্ষেপে সার্ক, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালকে মেয়েশিশুর দশক হিসেবে ঘোষণা করে। এ উপলক্ষে একটি অ্যানিমেটেড সিরিজ তৈরি করে দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের আনন্দ ও উৎসাহ দিতে চেয়েছিল জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)।মূলত UNICEF এই প্রকল্পটির ফান্ডিংয়ের প্রধান উৎস হলেও, এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু দাতা সংস্থা এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানও ভূমিকা রাখে।যেসব সংস্থা ফান্ডিংয়ে ভূমিকা রেখেছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
ডেনমার্ক সরকার (DANIDA) – ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এই প্রকল্পের আর্থিক সহযোগী ছিল।, নরওয়ে সরকার (NORAD) – নরওয়ের উন্নয়ন সংস্থাও এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।,কানাডা সরকার (CIDA) – কানাডিয়ান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ফান্ডিংয়ে অংশগ্রহণ করেছিল।,যুক্তরাজ্য সরকার (DFID) – ব্রিটিশ সরকারও এই প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছিল।, NOVA Nordic Foundation – ব্যক্তিগত ফাউন্ডেশন যারা ফান্ডিংয়ে অবদান রাখে।
এছাড়া, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংগঠন ও মিডিয়া হাউজ এই প্রকল্পকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছে। “মীনা” দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্পেইন হিসেবে শিশুদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। মীনা নিয়ে ভাবনার শুরু তখন থেকেই।
বলছি ঊনিশ শতকের মীনা কার্টুনের কথা । একটা কার্টুন দিয়ে যে সমাজব্যবস্থা বদলে দেয়া যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মীনা । ছোট্ট একটা গ্ৰাম সেখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস সঙ্গে সবার প্রিয় রাজু ও পোষা টিয়া পাখি (মিঠু) । স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাট্রিন , বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, ছেলে ও মেয়ের বৈষম্য দূরীকরণ কিংবা যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া এক অদম্য সাহসীকতার চরিত্র মীনা।
কাল্পনিক হলেও সত্য এ চরিত্র যেন বাস্তুবের চেয়ে সত্য।
এদেশের প্রায় শিশু কিশোররা এখনো গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে ” আমি বাবা মায়ের শত আদরের গানটি ।” জনপ্রিয় এই গানটির গীতিকার আরশাদ মাহমুদ ও ফারুক কায়সার । যেখানে কন্ঠ দিয়েছেন সুষমা শ্রেষ্ঠা । এই সম্পুর্ণ নির্মান ছিল পাকিস্তানের। ইউনিসেফ (unicef) এর তথ্যমতে শহরাঞ্চলের প্রায় ৯৭ আর গ্ৰামের ৮১ শতাংশ কিশোর কিশোরীই চিনে মীনা কার্টুনকে। এতেই আঁচ করা যায় কতটা জনপ্রিয় ছিল মীনা কার্টুন।
ফিলিপাইনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিমেশন স্টুডিও হান্না বারবারায় ১৯৯২ সালে মীনা কার্টুনের প্রথম বেশ কয়েকটি পর্ব নির্মাণ করা হয়। এরপর ভারত ও বাংলাদেশে মীনা কার্টুন তৈরি হয়েছে।১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে বিটিভিতে শুরু হয় এর প্রথম প্রচার ।এরপর ৩৭ সিরিজের কার্টুনটি অনুদিত হয় ২৯ টি ভাষায় ।তবে যার হাত ধরে রঙিন হয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি শিশু কিশোরের শৈশব নির্মিত হয়েছে মীনা কার্টুন।তার নাম নামটাই হয়তো অনেকেই জানেন না , তিনি হলেন ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অ্যানিমেটর রাম মোহন । সিরিজটি নির্মিত হয়েছিল মুম্বাইয়ের রাম মোহন বায়োগ্রাফিক্সয়ে ।
মীনা কার্টুন এর জনক হলেন রাম মোহন, যিনি অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বীকৃত। তাকে ভারতীয় অ্যানিমেশনের জনক বলা হয়।
রাম মোহন ১৯৩১ সালে মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অ্যানিমেশনের জগতে প্রবেশ করেন ১৯৫৬ সালে, ফিল্মস ডিভিশন অফ ইন্ডিয়া-তে যোগদানের মাধ্যমে। সেখানে তিনি তার অসাধারণ সৃজনশীলতা এবং দক্ষতা প্রদর্শন করেন। পরে তিনি রাম মোহন বায়োগ্রাফিকস প্রতিষ্ঠা করেন, যা ভারতীয় অ্যানিমেশন শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পরিচিত করে।
১৯৯১ সালে ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের অধিকার এবং শিক্ষা প্রচারের জন্য একটি চরিত্র তৈরি করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তারা রাম মোহনের সঙ্গে কাজ শুরু করে। তার নেতৃত্বে মীনা কার্টুন তৈরি হয়, যা পরে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ সমাজে মেয়েদের শিক্ষা ও সমতার প্রতীক হয়ে ওঠে। মীনার গল্পে প্রতিফলিত হয় একটি সাধারণ গ্রামীণ মেয়ের জীবনসংগ্রাম ও অর্জন।
তার অসাধারণ অবদানের জন্য রাম মোহন বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৪ সালে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার পান। তার কাজ অ্যানিমেশন শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
রাম মোহনের সৃষ্টিশীলতা এবং অঙ্গীকার মীনা কার্টুনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে যে পরিবর্তন এনেছে, তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার সৃষ্টি মীনা কার্টুনের গল্প শিশু-কিশোরদের শুধু বিনোদনই দেয়নি, তাদের মধ্যে সচেতনতা এবং ইতিবাচক পরিবর্তনও এনেছে।