নীলফামারী প্রতিনিধিঃ মোঃ গোলাম রব্বানী:
হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো। একসময় গ্রামবাংলার ছেলেমেয়ে পড়াশোনা ও বয়স্ক ব্যক্তিরা কর্ম ব্যস্ততার ফাঁকে বিভিন্ন ধরনের খেলায় কাটাত। এর মধ্যে কানামছি, দাড়িয়াবান্ধা, ডাংগুটি, ঘোড়া দৌড়, ফুটবল, লবণ কোঠা, গোল্লাছুট, লাঠি খেলা এবং পানিতে নেমে টগা, দীর্ঘ লাফ, মোরগ যুদ্ধ খেলা ছিল অন্যতম। এসব খেলার কথা এখন শুধু মুখে মুখেই শোনা যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব ও দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাংলার বিনোদনের উৎস এসব খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে।
বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার কিছু প্রচলন থাকলেও গ্রামাঞ্চল থেকে ঐতিহ্যবাহী এই খেলা প্রায় বিলুপ্তির পথে। পূর্বে প্রতিটি গ্রামের স্কুলের মাঠ, বাড়ির পাশের খালি জমি, হাট-বাজারের মাঠে প্রতিদিন বিকালে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা হতো। এসব প্রতিযোগিতায় টেলিভিশন, রেডিও, গরু, ছাগল, খাসি, কাপ, স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি উপহার দেওয়া হতো। বিজয়ীদের নিয়ে আসা পুরস্কার গরু-ছাগল দিয়ে আর প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল তুলে চলত গ্রাম্য ভোজের আয়োজন। এই প্রতিযোগিতায় ফুটবল খেলা এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রাম, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া, এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিবাহিত ও অবিবাহিত, হিন্দু ও মুসলমান এভাবে চলত।
গ্রামের মানুষ উৎসাহের সঙ্গে ফুটবল খেলা দেখে খুবই আনন্দ পেত। গ্রাম ও শহরের প্রতিটি বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও বিভিন্নভাবে ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত। একই রকম ছিল হা ডু ডু খেলার ঐতিহ্য। আধুুনিক বাংলাদেশে বর্তমানে ক্রিকেট খেলার কারণে সেই হা ডু ডু খেলাও হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান প্রজন্মের সন্তানদের কাছে হা ডু ডুসহ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো যেন রূপ কথার গল্পের মতো। এমন এক সময় ছিল যে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে খেলায়াড় ভাড়া করে নেওয়া হতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রাম ও ক্লাব পর্যায়ে প্রতিযোগিতার খেলায় যে আমেজ ছিল তার মজা একমাত্র যারা এই খেলা দেখেছেন তারাই বলতে পারেন।
প্রতিদিন স্কুলে ছুটির পর শিক্ষার্থীরা বাড়িতে এসে বিকালে নিজ বাড়ির উঠানে ও পাশের খালি মাঠে কানামাছি ও ভলিবল খেলত। সন্ধ্যা হলেই খেলা ছেড়ে ছেলেমেয়েরা প্রদীপ বা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসত। লুডু খেলাও ছিল অন্যতম খেলার মতো একটি প্রিয় খেলা। অবসর পেলেই ছোট-বড়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, স্বামী-স্ত্রী সবাই নিজ ঘরের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে লুডু খেলতে বসত। লুডু খেলায়ও চলত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বৃষ্টি নামলেই লুডু খেলা আর খই ও তেল মরিচ পেঁয়াজ মাখানো মুড়ি খাওয়ার ধুম পড়ে যেত।
তাস খেলাও একটি জনপ্রিয় শখের খেলা ছিল। মানুষ অবসর পেলেই আড্ডা আর তাস খেলায় মেতে উঠত। তবে বর্তমানে তাস দিয়ে সর্বনাশা জুয়া খেলা হয় বলে এর ঐতিহ্য অনেকটাই অম্লান হয়ে গেছে। লাটিম খুবই প্রাচীন একটা খেলা। ছোট-বড় সবাই বিকাল হলেই লাটিম খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। প্রতিযোগিতায় লাগত কে কার লাটিম ফাটাতে পারে। এর মধ্যে অন্য একটি প্রতিযোগিতা ছিল কে কত বড় লাটিম বানাতে পারে। লাটিম ঘোরার ভোঁ ভোঁ শব্দ মানুষের মনকে আনন্দ দিত।
নতুন প্রজন্মের কাছে ঐতিহ্যবাহী পুরোনো দিনের খেলাধুলার কথা বলতে তারা এটাকে শুধুই গল্প ছাড়া আর কিছু মনে করে না। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব ও দৈনন্দিন জীবন কর্মব্যস্ততার কারণে ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো বিলুপ্তির পথে। মানুষের নিত্য বিনোদনের জন্য এসব খেলা আবার ফিরিয়ে আনা উচিত। এতে এক দিকে ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো নতুন প্রজন্মকে উপহার দেওয়া যাবে। অপরদিকে অবসর সময়ে খেলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যায়ামের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এজন্য এসব খেলাকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দানের পাশাপাশি শারীরিক শিক্ষা ও ব্যায়াম, বেসরকারি ও সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান, ক্লাব ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন সচেতন মহল।