মোঃ মুস্তাক,
বিশেষ প্রতিনিধি:
আজ ১২ এপ্রিল ২০২৫ শনিবার সকাল ১০টা থেকে জাতীয় ঐক্য কমিশনের সাথে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – বাংলাদেশ জাসদ নেতৃবৃন্দের সাথে সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা বিষয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাসদের প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব নাজমুল হক প্রধান, কার্যকরী সভাপতি জনাব ইন্দু নন্দন দত্ত, স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ ড. মুশতাক হোসেন, জনাব এ টি এম মহব্বত আলী, জনাব আনোয়ারুল ইসলাম বাবু, জনাব করিম সিকদার, জনাব রফিকুল ইসলাম খোকন, জনাব রোকনুজ্জামান; সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব শাহজাহান আলী সাজু, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক জনাব এ এফ এম ইসমাইল চৌধুরী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে ছিলেন সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ, সদস্যবৃন্দ ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনাব সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, মনির হায়দার।
সভার শুরুতে উন্মুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশ জাসদ নেতৃবৃন্দকে স্বাগত জানান ড. আলী রিয়াজ। দল উত্থাপিত সংস্কার প্রস্তাবের ওপর ভূমিকা বক্তব্য দেন জনাব নাজমুল হক প্রধান এবং সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন ড. মুশতাক হোসেন। এরপর রুদ্ধদ্বার কক্ষে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রস্তাবের বিস্তারিত বিষয়ে দু’ঘন্টারও বেশি মতবিনিময় ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে বাংলাদেশ জাসদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন জনাব নাজমুল হক প্রধান ও ড. মুশতাক হোসেন।
বাংলাদেশ জাসদের পেশকৃত সংস্কার প্রস্তাবের সার-সংক্ষেপঃ
ভূমিকা
চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের চালিকা শক্তি ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ও বৈষম্য বিলোপের আকাঙ্খা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – বাংলাদেশ জাসদ এ লক্ষ্যে লড়াই করে আসছে। জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ও বৈষম্যের বিলোপের পন্থা উদ্ভাবনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে কার্যকর কর্মকৌশল প্রণয়নের জন্য বেশ কয়েকটি বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। কমিশনসমূহ ইতিমধ্যে ছয়টি বিষয়ে খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন। প্রস্তাবনাগুলো তৈরি করতে সংস্কার কমিশনের সদস্যবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তাদেরকে আমাদের দলের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
প্রস্তাবনা তৈরির আগে আমাদের দলের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিষয়ে লিখিত প্রস্তাবনা দিয়েছি। ছয়টি বিষয়ে কমিশনসমূহ বিস্তারিত প্রতিবেদন ও পাঁচটি বিষয়ে ছক আকারে সার-সংক্ষেপ আমাদের কাছে প্রেরণ করে। বাংলাদেশ জাসদ নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞগণ সেগুলো পর্যালোচনা করে দলের মতামত লিখিতভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সমীপে পেশ করেছেন। সে বিষয়গুলোতে মুখোমুখি আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের পরিসর বাড়ানোর জন্য আপনারা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে সাড়া দিয়ে আমরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি।
সংবিধান সংস্কার
প্রস্তাবনায় বেশ কয়েকটি যুগোপযোগী প্রস্তাব রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পাশাপাশি অন্যান্য মাতৃভাষার স্বীকৃতি, বহু জাতি-ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতির সহাবস্থান-মর্যাদা নিশ্চিত করা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের অধিকার সমূহের সমন্বিত করে একীভূতকরণ, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার সংজ্ঞা বিস্তৃতকরণ, মৌলিক অধিকারের সাধারণ সীমা নির্ধারণসহ ভারসাম্য ও আনুপাতিকতা পরীক্ষা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ও নারী আসন সংখ্যা বাড়ানো সহ সরাসরি নির্বাচন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রী-সংসদ নেতা-দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি না থাকা, গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে অনুমোদন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বন্টন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন ও এখতিয়ার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর পুনঃনির্বাচনের সীমারেখা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন পদ্ধতি ও এখতিয়ার, সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও সংস্কার, স্থানীয় সরকার সংস্কার ও ক্ষমতায়ন, সাংবিধানিক কমিশন, জরুরি অবস্থা জারীর পদ্ধতি প্রভৃতি। তবে এগুলোর কোন কোনটির বিষয়ে আমাদের আরো কিছু প্রস্তাব যুক্ত করেছি।
আমাদের দ্বিমত রয়েছে সংবিধানের মূলনীতি বদলের প্রস্তাবনা নিয়ে। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের প্রস্তাব না রাখা, অন্যান্য ধর্মীয় উপাদান বিযুক্ত করার প্রস্তাবনা না রেখে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি নাকচ করে যে ভাষাতেই সেগুলো প্রতিস্থাপন করা হোক না কেন, তা সংবিধান ও রাষ্ট্রের সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নাকচ করে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের সাথে সংবিধান তুলনীয় নয়। তাই সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও এর বাংলা অনুবাদ রাখাটা সমীচীন নয়। সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪এর গণঅভ্যুত্থানকে সমান গুরুত্ব দেবার চেষ্টার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করার প্রস্তাবনা গ্রহনযোগ্য নয়। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখের অবশ্যই ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে, সেই সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে ১৯৯০এর গণঅভ্যুত্থানও তাৎপর্যপূর্ণ। ’৯০এর গণঅভ্যুত্থানকেও সংবিধানে মর্যাদার সাথে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ৭ মার্চের ভাষণ অপসারণ আমরা সমর্থন করি না। দেশের নাম বাংলাতে পরিবর্তনকে আমরা অনাবশ্যক মনে করি। সংবিধানের ৫ম ও ৭ম সংশোধনী বাতিল থাকবে।
বাঙ্গালির বাইরে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে উল্লেখ করবার সময় ’আদিবাসী’ অভিধাটি তার সংজ্ঞা সহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। আদি ধরণের জীবনযাত্রা, ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও আদিবাসী প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনাক্রমে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা উচিত। বাঙ্গালিরাও এ ভূখন্ডের আদি বাসিন্দা, কিন্তু তারা আধুনিক জীবনযাত্রা ধারণ করেন – এ বিষয়টিও আদিবাসী সংজ্ঞাতে উল্লেখ করে বিভ্রান্তি দূর করা যায়। জোরপূর্বক সংবিধান বাতিল করা অপরাধ – এতদসংক্রান্ত সংবিধানের ৭ (ক) ধারা বিলুপ্ত করা যাবে না। শুধুমাত্র তরুণদের জন্য জাতীয় সংসদের কোটা রাখা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতার বয়সসীমা কমানো সমর্থন যোগ্য নয়। সংবিধানের ৭০ ধারা বাতিল করে শুধুমাত্র অনাস্থা প্রস্তাব ও অর্থবিল ছাড়া যে কোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যগণ দলের হুইপিং থেকে মুক্ত থাকবেন। উচ্চ কক্ষে শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন ও মাত্র ৫টি আসন বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে ফেলেছে। বিষয়টি নিয়ে অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধনের জন্য উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনই যথেষ্ট বলে আমরা মনে করি, গণভোটের আবশ্যকতা নেই। উচ্চ কক্ষের নির্বাচন জাতীয় সংসদের নির্বাচন থেকে পৃথক সময়ে করতে হবে। এক তৃতীয়াংশ আসনে পালাক্রমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের মত উচ্চ কক্ষ কখনো বিলুপ্ত হবে না। ভবিষ্যতে উচ্চ কক্ষ থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার কথা বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এককেন্দ্রিক (ইউনিটারি) রাজনৈতিক ব্যবস্থার বদলে বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে ফেডারেল পদ্ধতির রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা একটি যুগোপযোগী প্রস্তাব। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার
নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করার জন্য কমিশন বেশ কতকগুলো ভালো প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সেগুলোর সাথে আমরা একমত। যে সব বিষয়ে আমাদের সংযোজন ও ভিন্নমত রয়েছে সেগুলো পেশ করছি।
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র থেকে কর্মকর্তাদের পদায়ন বন্ধ করে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একই ভাবে মাঠ পর্যায়েও কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদেরকে জেলা-উপজেলাতে রিটার্নিং অফিসার ও অন্যান্য দায়িত্ব অর্পন করতে হবে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ বিদ্যমান বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ কর্তৃক শাস্তির বিধান নির্বাচন কমিশনারদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচকমন্ডলী বিস্তৃত করার প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু তা যেন নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি না করে।
বিচার বিভাগ সংস্কার
বিচার বিভাগের সংস্কার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবগুলো যুগোপযোগী। প্রকৃতপক্ষে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের যে সেব নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নই বিচার বিভাগের সংস্কার পূর্ণ করতে পারে। আমরা এটর্নি সার্ভিসের বিদ্যমান ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মতামত প্রদান করে বলেছি, নিয়োগের সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে। বিদ্যমান অন্যান্য প্রস্তাবগুলোর সাথে আমরা যোগ করেছিঃ মামলা দায়েরের পূর্বে সালিশ আবশ্যক। শুধুমাত্র সালিশী রোয়েদাদের বিপরীতে মামলা দায়ের করতে হবে। দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ ধারা সংশোধন করতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার
দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করার জন্য কমিশন বেশ কতকগুলো ভালো প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সেগুলোর সাথে আমরা একমত। তবে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের মত স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া দুদক নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে পারবে না। দুদকের মেয়াদ পাঁচ বছরই রাখা উচিত। দুদকের জবাবদিহিতার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকা দরকার। দুদকের ভুলের কারণে কোনো নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ক্ষতিপূরণের বিধান থাকা উচিত।
জনপ্রশাসন সংস্কার
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হচ্ছে বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে ফেডারেল পদ্ধতির রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা, যেটি সময়ের দাবি। সংস্কার একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। তাই একটি স্থায়ী ও স্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করে সংস্কারকার্য চলমান রাখা প্রয়োজন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পর্যবেক্ষণের জন্য নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব জবাবদিহিতার জন্য একটি দৃষ্টান্তমূলক প্রস্তাব। নতুন বিভাগ সৃষ্টি, উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত স্থাপন/ পুনঃস্থাপন করার প্রস্তাব গ্রহনযোগ্য। তবে সকল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে বিচার বিভাগের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ডেপুটি কমিশনারের ভুল বাংলা অনুবাদ ’জেলা প্রশাসক’ সংশোধন করার উদ্যোগ এতদিন পরে হলেও প্রশংসার দাবিদার।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ পৃথক করতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসি, ভূমি আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সরিয়ে বিচার বিভাগের অন্তর্র্ভুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে সিভিল সার্ভিসের বিদ্যমান কাঠামো থেকে আলাদা করার বিষয়ে অংশীজনদের সাথে আরো বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন, এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংস্কার কমিশনের সাথে সঙ্গতি রেখে তা করতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পূর্বের ন্যায় উপজেলা পরিষদের অধীনস্থ রাখতে হবে। জেলা- উপজেলা পরিষদের সচিবদেরকে সিভিল সার্ভিস থেকে ন্যস্ত না করে প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশন বা জেলা পরিষদ কর্তৃক সরাসরি নিয়োগ করতে হবে। সকল ক্যাডারের মাঝে সমতা নিশ্চিত করা, কোন বিশেষ ক্যাডারকে ঔপনিবেশিক আদলে ‘এলিট’ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা পরিহার করতে হবে। মন্ত্রীসভা কমিটি যুগ্ম সচিব থেকে উচ্চতর ধাপগুলোতে পদোন্নতির সুপারিশ করবে। সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে (এসইএস) পদপূরণে কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে সব ক্যাডার ও পেশার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। জেলা পরিষদকে বাতিল করার প্রশ্নই আসে না, বরঞ্চ জেলা পরিষদকে স্থানীয় সরকারের শীর্ষ ধাপ হিসেবে রেখে একই আইনে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা সহ সকল স্থানীয় সরকারকে একই কাঠামোতে নিয়ে আসতে হবে, এবং স্থানীয় সরকারগুলোকে সংবিধান অনুযায়ী পূর্ণ ক্ষমতাশালী করতে হবে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার সাথে সঙ্গতি রেখে তা করতে হবে।
পুলিশ সংস্কার
পুলিশ আইন ১৮৬১, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, পিআরবি ১৯৪৩ প্রভৃতি ঔপনিবেশিক কালো আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সরকারের নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি স্বাধীন পু্লিশ/ জননিরাপত্তা কমিশন গঠন করলে অর্থবহ সংস্কার হবে। জনকেন্দ্রিক ও জনবান্ধব পুলিশিং এর জন্য বিদ্যমান কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ও বিধি প্রণয়ন করতে হবে। মানবাধিকার কমিশন ও দুদককে শক্তিশালী করে তারা যেন সরাসরি পুলিশী কার্যক্রমের তদন্ত ও শাস্তি প্রদান করতে পারে, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। র্যাবকে টিকিয়ে রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই, একে বাতিল করতে হবে। সামরিক বাহিনীর মত পুলিশের প্রশিক্ষণকে চৌকস করতে হবে, পদোন্নতিতে এ প্রশিক্ষণকে মূল্যায়ন করতে হবে। পুলিশের পুরস্কার কাঠামো ও মানদন্ড বাহিনীতে দুর্নীতির অন্যতম উৎস। এটি অতীতে গুমের সংখ্যা উত্তোরোত্তর বেড়ে যাবার অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তথা জনগণের ওপর অমানবিক অত্যাচারের পরিমাণের ওপর পুরস্কার নির্ভর করতো। পুরস্কারের এ ধরণের মানদন্ড পরিবর্তন করে স্বাধীন দেশের উপযোগী করে অপরাধমুক্ত জনপদ গড়ে তোলার জন্য ইতিবাচক কর্মকান্ডের মাত্রার ওপর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের অন্যান্য উপযুক্ত মানদন্ড নির্ধারণ করে পুরস্কার পদ্ধতি নির্ধারণ করা দরকার। জনসংখ্যানুপাতে নারী পুলিশের সংখ্যা কম, দ্রুত আরো অন্ততঃ ৩০,০০০ নারী পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে। পুলিশ কল্যাণে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ও অন্যান্য বিষয়ে কমিশনের সুপারিশের সাথে আমরা একমত।
উপসংহার
সংবিধান, জনপ্রশাসন বিষয়ে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নে আমাদের দলের দ্বিমত রয়েছে। পুলিশ সংস্কার বিষয়ে কমিশন প্রদত্ত বিকল্প প্রস্তাব থেকে মৌলিক কিছু বিষয়ে প্রস্তাব করেছি। সংস্কার বিষয়ে আরো যে সব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিশনসমূহ প্রস্তাবনা দেবেন সেগুলোর সাথে এ ছয়টি বিষয় মিলিয়ে আমরা সার্বিক মতামত দিতে পারবো। তবে এ বিষয়গুলোর সাথে অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি বিষয়েও সংস্কার আলোচনা অনুরূপভাবে হওয়া প্রয়োজন। এটি সার-সংক্ষেপ। আমাদের বিস্তারিত প্রস্তাবনা লিখিতভবে ইতিমধ্যে কমিশনের প্রস্তাবনার পূর্বে ও পরে (ছকের মাধ্যমে) দেয়া হয়েছে। সেগুলোর সাথে মিলিয়ে এ সার-সংক্ষেপকে দলের মতামত হিসেবে গণ্য হবে। কমিশন সহ সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলোচনার পরিণতিতে আমাদের প্রস্তাবনাসমূহ চূড়ান্ত রূপ নেবে।
যে সব বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি হবে সেগুলো অধ্যাদেশ ও প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা যেতে পারে। যেসব প্রশ্নে দ্বিমত থাকবে সেগুলো পারস্পরিক আলোচনার সুযোগ রাখার জন্য জাতীয় সংসদ ও জাতীয় সংসদ দ্বারা তৈরি একটি সংলাপ কাঠামোকে সার্বক্ষণিক ভাবে দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। সর্বোপরি, সার্বিক সংস্কারের জন্যে একটি স্থায়ী স্বাধীন কর্তৃপক্ষ তৈরি করে সংস্কার কর্মকান্ড অব্যাহত রাখা উচিত। ধন্যবাদ।