হোসাইন মৃদুল নাগরপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় অবস্থিত চৌধুরী বাড়ি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা এ অঞ্চলের জমিদারি প্রথা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। চৌধুরী পরিবারের বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব ও স্থানীয় জনপদের প্রতি তাদের অবদান এই বাড়ির গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে। চৌধুরী বাড়ি স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। ভবনের কারুকাজ, প্রাচীন অলংকরণ এবং নির্মাণশৈলী সেই সময়ের শিল্প-সংস্কৃতির উজ্জ্বল উদাহরণ। বাড়ির ভেতরে বিশাল আঙ্গিনা, উঁচু বারান্দা এবং বড় প্রবেশদ্বার এর ঐশ্বর্যের পরিচায়ক। এটি একসময় স্থানীয় প্রশাসন, সামাজিক অনুষ্ঠান, এবং জনসাধারণের সাহায্য প্রদানকারী কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ইতিহাস বলে, চৌধুরী পরিবার জমিদারি প্রথার পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি, দাতব্য চিকিৎসা এবং মানবসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। তারা স্থানীয়দের জন্য স্কুল, মন্দির ,মসজিদ, এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক স্থাপনা নির্মাণে অবদান রেখেছেন। বর্তমানে চৌধুরী বাড়ি অতীতের গৌরবময় সময়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে, যা আমাদের ঐতিহ্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সহায়ক হবে। জমিদার বাড়ির দেয়ালগুলো তার সোনালী অতীতের কথা জানান দিতে দ্বিধা করছে না একটুও। আর তার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে নাগরপুরের জমিদার বাড়ির সুখ্যাতি ছড়ায় তৃতীয় পুরুষ উপেন্দ্র মোহনের ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর শাসন আমলে। প্রজা সাধারণের জন্য বিভিন্ন সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেন। তার ছোট ভাই সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী কলকাতায় ব্যবসা ও শিল্প সামলাতেন। ছোট ভাই সুরেশ ছিল সৌখিন, সংস্কৃতিমনা ও অত্যন্ত ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ। তার হাতে ধরে তৎকালীন কলকাতায় গড়ে ওঠে পূর্ব বাংলার ফুটবল ক্লাব 'ইস্ট-বেঙ্গল'। সুরেশ চন্দ্র নাগরপুরকে তৎকালীন রাজধানী কলকাতার আদলে সাজাতে চেয়েছিলেন। তখন বাড়িটির রঙ্গমহলের পাশে এক সুদৃশ্য চিড়িয়াখানা ছিল। সেখানে শোভা পেত- ময়ূর, কাকাতোয়া, হরিণ, ময়না আর শেষ দিকে সৌখিন সুরেশ চৌধুরীর ইচ্ছায় চিড়িয়াখানায় স্থান করে নিয়েছিল বাঘ এবং সিংহও। ৫৪ একরের এই জমিদার বাড়িটিতে বেশকিছু দুই ও তিন তলা ভবন রয়েছে।ভবনগুলোর বেশির ভাগই ধ্বংসের পথে। বর্তমানে কয়েকটি ভবনে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে দেখা গেছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তিনটির মধ্য রং মহল বর্তমানে নাগরপুর মহিলা কলেজ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হিসাবে তিনটি ব্যবহার হচ্ছে। আর ঝুলান দালান শিক্ষকদের কক্ষ,লাইব্রেরি এবং ক্লাস রুম। আরেকটি ভবনে কেবল শুনশান নীরবতা। এই বাড়ির অন্যতম স্থাপনা হলো ঝুলন দালান। প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন শিল্প কর্মে মণ্ডিত এই ভবনে চৌধুরী বংশের নিত্যদিনের পূজা অনুষ্ঠিত হতো। বিশেষ করে বছরে শ্রাবণের জ্যোৎস্না তিথিতে সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের নাটক, যাত্রার আসর হতো। অট্টালিকাটির অভ্যন্তরের পুরো কাজটি সুদৃশ্য শ্বেত পাথরে গড়া। আর এখানেই চৌধুরী বংশের শেষ প্রতিনিধি মিলন দেবী নিরাপত্তাহীনতায় দুষ্কৃতকারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ঝুলন দালানের ছাদ থেকে সামনে চোখ রাখলেই দেখা মিলবে বিশাল দিঘি আর তার ওপারে স্বমহিমায় শৈল্পিক কারুকাজ খচিত স্থাপনার নাম ঘোড়ার দালান। জমিদারী পরিচালনা এবং বাবসায়িক প্রয়োজনে চৌধুরী বাড়িতে সুঠাম সুদৃশ্য ঘোড়া পোষা হতো। আর এই ঘোড়া এবং তার তদারকিতে নিয়োজিতদের থাকার জন্য নির্মাণ করা হয় বিশাল ভবন। যা জমিদারদের ঘোড়ার দালান হিসাবে পরিচিত। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সরকার চৌধুরী বাড়ির সকল সম্পদ অধিগ্রহণ করে। জানা যায়, জমিদার সুবিদ্ধা খাঁ-র হাত ধরে নাগরপুরে চৌধুরী বংশ জমিদারি শুরু করেন। এই বংশের প্রথম পুরুষ যদুনাথ চৌধুরী প্রায় ৫৪ একর জমিতে তার জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরবর্তী সময়ে জমিদারির হাল ধরেন তার তিন ছেলে উপেন্দ্র মোহন চৌধুরী, জগদীন্দ্র মোহন চৌধুরী, শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী। স্থানীয়রা মনে করেন, চৌধুরী বাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন নাগরপুরের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও প্রসারিত করবে। চৌধুরী বাড়ির অতীতের গৌরবময় ইতিহাস আজও তার দেয়াল, স্থাপত্য এবং কিংবদন্তির মধ্য দিয়ে জেগে আছে। তবে সময়মতো সংরক্ষণের অভাবে এই ঐতিহ্য ধ্বংসের মুখে পড়ছে। এটি শুধু একটি বাড়ি নয়, বরং এটি আমাদের অতীত ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রমাণ।
সম্পাদক ও প্রকাশক:- মোঃ আবির ইসলাম
নির্বাহী সম্পাদক:- জামিল চৌধুরী
বার্তা সম্পাদক:- আরিফুল ইসলাম
হেড অফিস: ৪৭,পুরানো পল্টন আরবান পল্টন ভিউ কমাশিয়াল কমপ্লেক্স (৫ম তলা)
নিউজ মেইল: dainikprothombarta@gmail.com
যোগাযোগ: ০১৬৪৩-০৩১৩৭২/০১৮৬৮-৮৪৫৫৯৬
দৈনিক প্রথম বার্তা কর্তৃপক্ষ
Design And Develop By Coder Boss