হোসাইন মৃদুল,নাগরপুর ( টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি:
শিশুদের জীবনের প্রথম পর্যায়ের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাকে আনন্দের সাথে, ছন্দের সাথে, আকর্ষণীয় শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে ১৫ ই এপ্রিল ২০০৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সিসিমপুর কার্টুনটির যাত্রা শুরু করে। সিসিমপুর শিশুদের বিনোদনের জন্য অন্যতম কার্টুন।এই সিসিমপুর কার্টুনটি বর্তমানে বিটিভি সহ আরটিভি, দুরন্ত টিভি, দিপ্ত টিভি,মাছরাঙা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় ।
সিসিমপুর টেলিভিশনে প্রথম প্রচারের
দিন হিসেবে প্রতিবছর ১৫ ই এপ্রিল ‘সিসিমপুর দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এ বছর সিসিমপুর এপ্রিলে ২০ তম বছরে পদার্পণ করবে। ঊনিশ শতকের জনপ্রিয় ও শিক্ষা মূলক মীনা কার্টুনের পরেই ০১ কোটি ২০ লক্ষ দশকের অন্তরে জায়গা করে নেয়। তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রায় বিশ বছর ধরে বিরতিহীনভাবে সিসিমপুর কার্টুন সম্প্রচার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় , বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং সিসিমপুরের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফল।
টেলিভিশনে সিসিমপুর কার্টুন বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মুদ্রিত বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে শিশুদের বর্ণ চেনা, শুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষা, শব্দ থেকে বর্ণ চিহ্নিত করা , বাক্য গঠন ও লিখন, বর্ণ দিয়ে শব্দ মেলানো ইত্যাদি শিখাতে সহায়তা করে। আমাদের চারপাশের পরিবেশে থেকে উপকরণ খুঁজে নিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে বর্ণ ও শব্দ চিনতে সাহায্য করে ।বল ,ব্যাট ,ঘর, টেবিল, দরজা ,জানালা,ঘড়ি ,কলম,বই,যানবাহন, সবজি , আম, কাঁঠাল, নারিকেল, হাঁস, মুরগি,গরু , ছাগল , কাস্তে,কোদাল ইত্যাদি শিশুর পরিচিতি বিভিন্ন শব্দ কোন বর্ণ দিয়ে শুরু হয়,তা বিনোদন ও খেলাধুলার ছলে শেখানো হয়।
সিসিমপুরের চরিত্রগুলোর মাধ্যমে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান থেকে বিভিন্ন আকার -আকৃতির নাম , রঙের নাম, গাণিতিক ধারণা ইত্যাদি শেখানো হয়।বাংলাভাষার শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়টিকে সিসিমপুর সবসময়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে। আর তাই সিসিমপুরের সব ধরনের পর্বে চরিত্র অনুযায়ী প্রত্যেকের শুদ্ধ উচ্চারণকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে শিশুরা এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রমিত বাংলা শোনার ও চর্চা করার সুযোগ পায়। আবার একইসাথে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা, ঐতিহ্য আর জীবনযাপনকেও তুলে ধরা হয়। যাতে করে শিশুরা সমানভাবে আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতি এবং ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হয়।বর্তমানে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের জেলার ৫টি উপজেলার ২৫০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করছে সিসিমপুর। ইউএসএআইডি/বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতায় এসব স্কুলের শিশুদের বিশেষ করে প্রান্তিক শিশুদের শেখার দক্ষতা বৃদ্ধি ও স্কুলে বৈষম্যহীন শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছে। এজন্য স্কুলগুলোর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, স্কুলগুলোতে শিক্ষা উপকরণ প্রদান ও সিসিমপুর পাঠাগার তৈরি, অভিভাবক ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে অভিভাবক সমাবেশসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিসিমপুর।
প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শিশুদের কাছে অন্যতম আকর্ষণের বিষয়ে পরিণত হয়েছে সিসিমপুর। মেলায় প্রতি শুক্র-শনি আর ছুটির দিনগুলোতে ইকরি, হালুম, টুকটুকি আর শিকুর সঙ্গে মজার সময় কাটাতে শিশুদের ঢল নামে। যা ইতোমধ্যেই অমর একুশে গ্রন্থমেলার অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্রেইলে লেখা দশটি গল্পের বই প্রকাশ করেছে সিসিমপুর। এছাড়া অচিরেই সিসিমপুরের কিছু পর্বে যুক্ত করা হবে ইশারা ভাষা। দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে সিসিমপুরের সঙ্গে যুক্ত করতেই এই উদ্যোগ ।
সিসিমপুরের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম ।সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশের সব কার্যক্রমই সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত হয়। গত প্রায় ২০ বছরে সিসিমপুর বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে চলেছে। এছাড়া সিসিমপুরের পথচলায় পাশে আছে ইউএসএআইডি/বাংলাদেশসহ আরও কিছু দাতা সংস্থা।নিউইয়র্কভিত্তিক সিসেমি স্ট্রিট নামক শিক্ষামূলক টেলিভিশন-ধারাবাহিকের সহপ্রযোজনা সিসিমপুরের কার্যক্রম বাংলাদেশে পরিচালনা করছে সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশ।কিডস্ক্রিন এওয়ার্ড, এন্থেম এওয়ার্ডের পর ২০২৩সালে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ইন্টারন্যাশনাল টেলি এওয়ার্ড জিতেছে সিসিমপুর।
সিসিমপুর টিভি সিরিজে নতুন চরিত্র জুলিয়ার অন্তর্ভুক্তি এবং পর্বগুলোতে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা যুক্ত করে বৈচিত্র্য, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তির বার্তার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখায় সিসিমপুরকে ৪৫তম টেলি এওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। শুরু থেকেই ইউএসএআইডি বাংলাদেশ-এর আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হয়ে আসছে সিসিমপুর।সিসিমপুরে যাদের অভিনয় করতে দেখা গেছে।ইকরি,হালুম,শিকু,টুকটুকি ,পারুর,খোকা মিয়া ,চঞ্চল চৌধুরী,এলেমো, বার্ট, আর্নি,রায়া, বিস্কুট পাগলা,পার্বতী, মি. গ্রোভার, আশা,শেরালি, মানিক- রতন,লাল মিয়া, মুকুল, সুমনা,গুণী ময়রা, শান্ত, বাহাদুর ।
সিসিমপুরের জনপ্রিয় এপিসোড গুলোর মধ্যে সুপার গ্রোভার, ইকরি-মিকরির মজার খেলা, হালুমের খেলার মাঠের অভিযান, টুকটুকির গল্পের ঝুলি, শিকুর বিজ্ঞান পরীক্ষার দিন, বিস্কুট পাগলার দুঃসাহসিক অভিযান, রঙিন পৃথিবীর রঙ শেখা, চঞ্চল চৌধুরীর সাথে বিশেষ পর্ব, শব্দ মেলা ও বর্ণ গঠনের পাঠ,জুলিয়ার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষা
ইউএসএআইডি বাংলাদেশ-এর সিসিমপুর প্রকল্পটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৫০০০ এর বেশি প্রাথমিক শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেছে। এই প্রকল্পটি স্কুলগুলিতে লাইব্রেরি স্থাপন এবং হাজার হাজার গল্পের বই বিতরণের মাধ্যমে পাঠ এবং সাক্ষরতার একটি সংস্কৃতি তৈরি করেছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ১,০০০ এর বেশি শিক্ষক। যার ফলে তাঁরা শিশুদের বই পড়তে এবং আবৃত্তি, গল্প বলা, গান গাওয়া, গল্পকে নাটকে রূপ দেওয়া ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে সহায়তা করতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, গত বছর আমাদের প্রকল্প স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রায় ১,৫০,০০০ গল্পের বই লাইব্রেরি থেকে পড়ার জন্য নিয়েছে। সিসিমপুরের বন্ধুরাও বই পড়তে ভালোবাসে।
সিসিমপুর কেবল একটি কার্টুন নয়; এটি শিশুদের মানসিক বিকাশ, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে শিশুদের মাঝে শিক্ষা ও বিনোদনের সুন্দর সমন্বয় তৈরি হয়েছে। সিসিমপুরের এই পথচলা আগামী দিনগুলোতেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবে, এমনটাই প্রত্যাশা।