হোসাইন মৃদুল,নাগরপুর ( টাঙ্গাইল)প্রতিনিধি:
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি শুধু একটি স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন নয়, বরং এই অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।ইংরেজ আমলের শেষ দিকে এবং পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তৎকালীন ব্রিটিশ রাজাধানী কলকাতার সাথে মেইল স্টিমারসহ মাল এবং যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। একপর্যায়ে নাগরপুরের সাথে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তীতে পশ্চিম বঙ্গ কলকাতা থেকে আসেন রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল (ধনাঢ্য ব্যক্তি)।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তিনি পাকুটিয়ায় জমিদারী শুরু করেন। প্রায় ১৫ একর এলাকা জুড়ে একই নকশার পর পর তিনটি প্যালেস বা অট্টালিকা নির্মাণ করা হয় (১৯১৫)। তখন জমিদার বাড়িটি তিন মহলা বা তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। এবং এই স্থান এর জমিদাররা তাদের প্রজাদের তাদের জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে বা ছাতা মাথাই দিয়ে যেতে দিতো না।
জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র সাহা এবং তাঁর উত্তরসূরিরা এই জমিদারি পরিচালনা করতেন। জমিদারির কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বাড়িটি, যা সে সময়ের ক্ষমতা, ঐশ্বর্য এবং সামাজিক অবস্থানের প্রতীক হিসেবে নির্মিত হয়। জমিদাররা কৃষি, ব্যবসা এবং দাতব্য কাজের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জীবনে প্রভাব বিস্তার করতেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে এই জমিদার বাড়ি ছিল স্থানীয় প্রশাসনিক ও সামাজিক কার্যক্রমের কেন্দ্র। জমিদাররা সংস্কৃতির প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। বিশেষ করে দুর্গাপূজা ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাড়িতে আয়োজিত উৎসবগুলো ছিল স্থানীয়দের জন্য বিশাল আকর্ষণ।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি মুঘল এবং ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত। এটি লাল ইট এবং চুন-সুরকির মিশ্রণে তৈরি। বাড়ির সামনের দিকে দৃষ্টিনন্দন নকশা এবং প্রবেশপথে সুদৃশ্য খিলান রয়েছে। ভবনের অভ্যন্তরে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা, সুসজ্জিতছ কক্ষ এবং ঝুলবারান্দা। জমিদার বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি বিশাল পুকুর, যা তখনকার দিনগুলিতে বাড়ির সৌন্দর্য ও ব্যবহারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রতিটি বাড়ীর মাঝ বরাবর মুকুট হিসাবে লতা ও ফুলের অলংকরণে কারুকার্য মন্ডিত পূর্ণাঙ্গ দুই সুন্দরী নারী মূর্তি রয়েছে। এবং প্রতিটি মহলের রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য। রেলিং টপ বা কার্নিশের উপর রয়েছে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ছোট আকৃতির নারী মূর্তি। এই অট্টালিকা গুলো পাশ্চাত্য শিল্প সংস্কৃতির এক অনন্য সৃষ্টি, যার লতাপাতার চমৎকার কারুকাজ গুলো মুগ্ধ করার মতো। এছাড়া পূজা মন্ডপের শিল্পিত কারুকাজ শতবছর পর এখনও পর্যটককে মুগ্ধ করে
তিনটি নাট মন্দির যা তিনটি বাড়ীর সামনে অবস্থিত। দ্বিতল বিশিষ্ট নাচঘরটি মাঠের মাঝখানে রয়েছে। উপেন্দ্র সরোবর নামে বিশাল একটি আট ঘাটলা পুকুর রয়েছে।
এই জমিদার বাড়িটি স্থানীয় ঐতিহ্যের একটি মাইলফলক। এখানে একসময় দাতব্য চিকিৎসালয়, শিক্ষা কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতো। জমিদাররা দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, যা তাদের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
বর্তমানে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অনেক অংশ ভেঙে পড়েছে, এবং অবহেলার কারণে ভবনটি ধ্বংসের মুখে। তবে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সংরক্ষণ করার দাবি তুলেছে।
স্থানীয়দের মতে, পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি এখনো তাদের গর্বের একটি প্রতীক। তবে তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে বাড়িটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং সরকারি নজরদারির অভাবে এটি ধ্বংস হতে বসেছে। অনেকেই মনে করেন, সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে এটি সংস্কার করলে এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
যদিও বর্তমানে জমিদার বাড়ির ভবনটি শিক্ষার প্রসারের জন্য সেখানে পাকুটিয়া বি. সি. আর. জি.ডিগ্রী কলেজটি কার্যক্রম চালু হয়েছে।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। এটি সংরক্ষণ করলে স্থানীয় অর্থনীতি, পর্যটন এবং ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন সম্ভব।