মাসরিকুল হাসান সোহেল:
নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবদানকে স্মরণ করে তার জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৮৮০ সালের এই দিনে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দের এক নিভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ১৯৭৪ সাল থেকে পায়রাবন্দবাসী তাকে স্মরণ করে রোকেয়া দিবস পালন করে আসছে।
সরকারিভাবে ১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হয়।
রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি নারী জাগরণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়া।
সে সময় মুসলিম সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনো প্রচলন ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পরিবারের সবার অগোচরে বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়া ও লেখা শেখেন।
স্বশিক্ষিত রোকেয়াকে বিদ্যালয়ের অপর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থানের মধ্যেই ছাত্রীদের বিকাশে দিনরাত খাটতে হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানব জাতি পুরুষ ও নারীর মিলিত ধারারই ফল।
পুরুষ ও নারীর সম্মিলনে গঠিত বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী একে অন্যের সহযোগী পরিপূরক। এ মানবিক দর্শনকে সামনে রেখে নিগৃহীত ও পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই তাঁর শিক্ষা প্রচেষ্টা শুরু হয়। নারী সমাজকে উচ্চ জীবনবোধে উজ্জীবিত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। নারীর মানসিক বিকাশকে রুদ্ধ করে মানব সভ্যতার বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে—এমন বিষয়গুলো ধরিয়ে দিতে তিনি লিখেছেন শিক্ষামূলক, সমাজ সংস্কারমূলক বিভিন্ন গল্প কবিতা। প্রবন্ধ ও ব্যঙ্গ রচনায় তাঁর লেখা ছিল ক্ষুরধার। শাণিত লেখনী কখনো কখনো পুরুষশাসিত সমাজকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছে।
রোকেয়া রচিত সাহিত্যের সংখ্যা বিপুল না হলেও প্রতিটিই অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। এ ছাড়া সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন সমিতির কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯১৬ সালে তিনি ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ গঠন করেন। নিরক্ষর ও দরিদ্র নারীদের আত্মনির্ভর করতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনাই ছিল এ সমিতির উদ্দেশ্য। সরাসরি অর্থ সাহায্য না করে এ সমিতি সুস্থ নারীর স্থায়ী পুনর্বাসনে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিত। বেগম রোকেয়া নারীর লাঞ্ছনা অত্যন্ত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর নিজ পরিবারে মেয়েদের চলাফেরা ও শিক্ষায় কোনো স্বাধীনতা ছিল না। একজন নারী-পুরুষের মতো পরিবারের সদস্য হয়েও ছিল পুরুষের অধীন এবং পুরুষ রচিত বিধিনিষেধ তাকে মানতে হতো। তিনি নারীর মর্মবেদনা ও চাহিদা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।
কাজ করতে গিয়ে বেগম রোকেয়া বাধার পাশাপাশি সহযোগিতাও পেয়েছেন। প্রবল প্রতিরোধের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি নারীর অগ্রযাত্রার পথ নির্মাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষা লাভ ও মূল্যবোধ গঠনে তার ভাই ও বড় বোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে বিহারের ভাগলপুরে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর উৎসাহে ও নিজের আগ্রহে তিনি লেখাপড়ার প্রসার ঘটান।
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড:
স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক কারণে রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা একশত পেরিয়ে যায়।[১৩] স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।[১১] ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো দুঃসাহসিক কাজ।[১৪]
নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কর্ম ও আদর্শকে সামনে রেখে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অনন্য অর্জনের জন্য প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।
রোকেয়া সাখাওয়াত ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো-মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী।