মাসরিকুল হাসান সোহেল:
উত্তরবঙ্গের উচ্চশিক্ষার বাতিঘর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর (বেরোবি) ১৬ বছর পেরিয়ে এসেছে। জাতি গঠন ও রাষ্ট্রীয় চাহিদা পূরণে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে এ বিদ্যাপীঠ। তবে বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি তার মূল কাজ– নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও বিতরণে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক মানের বিবেচনায় যেমন অনেক পিছিয়ে রয়েছে, তেমনি নানা ধরনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনের বিমাতাসুলভ পক্ষপাতমূলক আচরণ ও স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হয়ে ছিল। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে বড় পরিবর্তন এসেছে। গণঅভ্যুত্থানে পূর্ববর্তী সরকারের পতন এবং নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমনে দেশজুড়ে পরিবর্তনের বাতাস বইছে। বেরোবিরতে নতুন ভিসি ও প্রক্টর নিয়োগ সেই পরিবর্তনের অংশ। শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, এই পরিবর্তনের হাওয়া তাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়বে।
নতুন প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রথম প্রত্যাশা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ত্রাসের রাজনীতি বন্ধ করা। এ অপরাজনীতির প্রভাব শিক্ষার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বাংলা বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী বলেন, ‘শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সব স্তর রাজনীতির প্রভাব মুক্ত করে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা হোক। ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন পুনরায় চালু করার দাবি শিক্ষার্থীদের । ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হলে অস্বাস্থ্যকর রাজনীতির পরিবর্তে ক্যাম্পাসে ছাত্ররা শিক্ষিত জাতি বিনির্মাণে সুস্থধারার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
আবাসন সংকট :
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বেরোবিতে ভর্তি হন কিন্তু পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় এবং হলগুলো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অছাত্রদের দখলে থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় চরম বিপাকে। এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘গণরুম’ নামক চরম অমানবিক একটি অত্যাচারের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল খুনি সরকারের আমলে।এর থেকে রেহাই চায় নবীন শিক্ষার্থীরা।
গনিত বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী বলেন, “শিক্ষার্থীদের সেখানে ‘দাস প্রথার’ মতো রেখে বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক প্রোগ্রাম করানো হয় এবং প্রতি রাতে ‘গেস্টরুম’ নামক টর্চার রুমে নির্যাতন করা হয়। নতুন প্রশাসনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা– অতিসত্বর এ গণরুম ও গেস্টরুম প্রথা চিরতরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় করা হোক এবং আবাসন ব্যবস্থার সমাধান করা হোক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ সম্পর্কে :
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক বাজেট প্রণয়ন ও তা সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা না গেলে শিক্ষার মানোন্নয়ন অসম্ভব। তাই নতুন প্রশাসনের প্রতি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা– বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং তার ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছতা আনা হোক।
মেডিকেল এর জায়গা ও পর্যাপ্ত চিকিৎসকের অভাব:
বেরোবির নবীন শিক্ষার্থী তাঁর প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘নতুন প্রশাসনের কাছে অনুরোধ দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেডিকেল বিল্ডিংয়ের কার্যক্রম আধুনিকায়ন করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করিয়ে পেশাদার আচরণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন।
লাইব্রেরিতে জায়গা সংকট:
ব্যবসায় অনুষদের নবীন শিক্ষার্থী জানান, ‘আমাদের -লাইব্রেরি গত কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম সেখানে গিয়ে দেখতে পাই শিক্ষার্থীর তুলনায় পড়ার জায়গার সংকট। ফলে আমাদের পড়াশোনার ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটতে পারে।তাই নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে দ্রুত সময়ে পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থার করার জন্য দাবি জানাচ্ছি ।
নতুন জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনোগ্রাফ, থিসিসের জন্য ফান্ড বরাদ্দ করতে হবে। এ বিষয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার বা গবেষণা মেলা আয়োজন করা উচিত। সব বিভাগেই গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় যেন ভাবতে শেখায় আমাদের।
বাসের সংকট :
নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের ঘুড়ে বেড়া অনেক স্বপ্নের কিন্তু বেরোবিতে পর্যাপ্ত বাসের সংকট রয়েছে যেটা গতকাল বাসের ওঠার পর বুঝতে পেরেছি,পুরো রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে।শিক্ষার্থীদের তুলনায় বাসের সংখ্যা অনেক কম তাই কতৃপক্ষের কাছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করার দাবি জানাচ্ছি।
অডিটোরিয়ামের অভাব:
বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোন অডিটোরিয়াম। একটি অডিটোরিয়াম হল একটি রুম যা দর্শকদের পারফরম্যান্স শুনতে এবং দেখতে সক্ষম করার জন্য তৈরি করা হয় যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একান্ত জরুরি কিন্তু অডিটোরিয়াম এর অভাবে বড় অনুষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব না,। একজন নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে কতৃপক্ষের কাছে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অডিটোরিয়াম এর জন্য দাবি জানাচ্ছি।
পোশাক সম্পর্কে মন্তব্য :
পোশাকের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। শিক্ষার্থীরা চান, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো পোশাক পরতে পারেন এবং কোনোভাবেই তাদের পোশাকের কারণে হেনস্তা হতে না হয়। ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার ক্যাম্পাসে ওয়েস্টার্ন থেকে শুরু করে হিজাব-নিকাব, যে কোনো পোশাকের জন্য কাউকে যেন ছোট করা না হয়। এটাই প্রত্যাশা।’
শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সুযোগ সামনে এসেছে, তাতে নতুন প্রশাসন তাদের এ প্রত্যাশাগুলো পূরণ করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক, শিক্ষার্থীবান্ধব ও বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবে।