চারিদিকে নদী ও সুন্দরবন বেষ্টিত বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে খুলনার কয়রায় একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে দীর্ঘদিন ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে রয়েছে উপকূলবাসি। উপকূলের জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে ভয়ার্ত মাস মে মাস। গত কয়েক বছর ধরে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো হয়েছে তার অধিকাংশই হয়েছে এই মাসে। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় আসলে ভয়ংকর আতঙ্কে কাটে তাদের জীবন।নতুন করে আবার শক্তি সঞ্চার করে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল । এভাবেই বিভিন্ন ঝড়ে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারলেও প্রতিবার তাদের বসত ঘর, ফসলি জমি, গবাদি পশু, মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খুলনার উপকূলীয় লাখো মানুষ প্রহর গুনছে কখন আঘাত হানবে ঝড়।
উপকূলীয় কয়রার বাসিন্দা দিনমজুর মজিবর বলেন, গতবছরের ঝড়ে আমার বাড়ির সব ভাইঙে গিসিলো। কোনো রহমে ঠিক কইরে থাহি। আবার নাকি ঝড় আসতিছে। ঝড় হলি পোলাপান নিয়ে স্কুলে যাইয়ে উঠবানি। ঝড় তো এখন আমাগে সঙ্গী মনে হয়। প্রতিবছর ঝড় আসে, বাঁধ ভাঙ্গে। গ্রামের সবাই মিলে বাঁধ দিই। তয় এবার ভয় করতিছে ভরা চান্দের সময় বলি।
সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, রোয়ানু, নার্গিস, কোমেন, ফণী, আম্ফান, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদের নতুন ভয়ংকর আতঙ্ক অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল । অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানলে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে উপকূলের বাসিন্দারা মনে করছেন, এখন ভরা পূর্ণিমা প্রায় ৩০ বছর পর ভরা পূর্ণিমার জোয়ারের সময়ে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে।
ইতিমধ্যে কয়রার শাকবাড়িয়া ও কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১০ কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন উপকূলের তিন লাখ বাসিন্দা। উপকূলীয় এলাকা এবং নদী তীরবর্তী এলাকা গুলোতে সর্তক থাকা ও পূর্ব প্রস্তুতি নিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ বলা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, কয়রা উপকূলের কপোতাক্ষ নদী ও শাকবাড়িয়া নদী এলাকায় প্রায় তিন লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করে আসছে। ঝড় এলেই তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হন তারা। ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হলেও সর্বনাশ ডেকে আনে জলোচ্ছ্বাসে।ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। আসন্ন ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল ’ নিয়ে ভয়ের মধ্যে রয়েছে। উপকূল জুড়ে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে হরামেশা কোনো না কোনো বিপর্যয়ের শঙ্কা থাকেই দক্ষিণাঞ্চলে ।প্রতিবারই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে কয়রা উপকূলের মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে।এমন পরিস্থিতিতে নীচু জায়গায় উঁচু বাঁধের ও নদী ভাঙন প্রতিরোধের দাবি জানিয়েছেন উপকূলবাসী।
উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জোহরা, মল্লিকা দাষ, ও আমেনা বেগম বলেন, একটি ঘূর্ণিঝড় আসবে সেটা জেনেছি, আমাদের ভীষণ ভয় হচ্ছে। ঝড়ের সময় মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি।ভয় হয় জলোচ্ছ্বাসের। জলোচ্ছ্বাসের কারণে এবারও আমরা ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। আমরা চাই বাঁধগুলো যেন আরও উঁচু হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২২ -২০২৩ অর্থ বছরের শেষের দিকে কয়রা উপজেলায় ১১ শ’ ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২ কিলোমিটার বেঁড়িবাধ নির্মাণ কাজ চলমান। ২০২৩ সালের শেষের দিকে জায়কার অর্থায়নে ১০০ কোটি ব্যয়ে দেড় কিলোমিটার বেঁড়িবাধ মেরামত করা হয়। এর আগে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে কয়রা উপজেলার ২১ টি পয়েন্টে বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হওয়া স্থান গুলো মেরামত করা হয়। উপজেলায় ১৫৪ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ১০ কিলোমিটার বেঁড়িবাধ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যে পয়েন্টে বেঁড়িবাধ ঝুঁকিতে আছে। কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালি এলাকায় ১ কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় ২ কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় ৩ কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকায় পানি প্রবেশ করার শঙ্কা রয়েছে । এছাড়া কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতে পানি সরবরাহের আটটি জলকপাট (স্লুইসগেট) অকেজো পড়ে আছে। ৪ মাস আগে ঝুঁকিপূর্ণ ১৩ টি জলকপাট (স্লুইসগেট) মেরামত করা হয়ে।
বারবার বাঁধ ভাঙনে নিঃস্ব মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের সেই ঘুরে দাঁড়ানোকে বারবার সর্বস্বান্ত করে বাঁধের ভাঙন। বালু দিয়ে বাঁধ দেওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন গোবরা গ্রামের কপোতাক্ষ পাড়ের বাসিন্দা আলামিন ইসলাম। ঘূর্ণিঝড় আসলেই ভয়ংক আতঙ্ক কাজ করে তাদের।
কয়রা সবুজ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে। বেড়িবাঁধের উচ্চতা বাড়াতে না পারলে উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। কয়রার বাঁধগুলোর উচ্চতা আরও অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো উচিত।”তিনি আরও বলেন,
এদিকে স্বেচ্ছাসেবকসহ ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সদস্যদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ প্রস্তুতি সভায় দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাইক্লোন শেল্টারসমূহ তত্ত্বাবধান, আশ্রয়কেন্দ্রে সুপেয় পানি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহে একাধিক কমিটি গঠন করা হয় কয়রা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবেলায় উপজেলায় খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,সরকারি-বে-সরকারি ভবনগুলোও প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি, প্রস্তুত রাখা হয়েছে ১১৬ টি আশ্রয়কেন্দ্র। কেন্দ্রগুলিতে ৩২ হাজার ৫ শত মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। মজুদ রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত শুক।